কোভিড-১৯-এর জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) উৎস অনুসন্ধানে সম্প্রতি চীনের উহানে গিয়ে কাজ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞ দল। এই দলেরই একজন সদস্য ব্রিটিশ প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞ পিটার ডাসজাক।
পিটার ডাসজাক মনে করেন, উহানের গবেষণাগার থেকে করোনাভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমনকি উহানের আলোচিত হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটও ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক কেন্দ্র নয়। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের অন্য কোনো প্রদেশ থেকে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ঘটে ওই মার্কেটে। বিশ্বজুড়ে আলোচিত সেই মার্কেট এখনও স্থানীয়দের জন্য নিষিদ্ধ। চলছে নানা ধরনের অনুসন্ধান।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে পিটার ডাসজাক বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রকৃত উৎস জানতে আরও অনুসন্ধান দরকার। তবে সেই অনুসন্ধান হতে হবে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে।
পিটার ডাসজাক ব্রিটিশ নাগরিক হলেও তিনি ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের প্রধান হিসেবে নিউইয়র্ক সদরদপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সাক্ষাৎকারটি নিউজবাংলার পাঠকের জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মোশফেকুর রহমান।
চীন ও উহানে আপনি আগে অনেকবার গিয়েছিলেন। এবারের অভিজ্ঞতা কেন ব্যতিক্রমী?
পিটার: এবারের অভিজ্ঞতা ছিল উদ্ভট। এর আগে, চীনে গেলে আমরা প্রচলিত নিয়মে কয়েকটি কাজ করতাম। প্রথমটি হলো, সংশ্লিষ্ট চীনা নাগরিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ভোজে অংশ নিতাম। এবার হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় জুমে টানা দুই সপ্তাহ চীনাদের সঙ্গে মিটিং করেছি। এরপর তাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়েছে, তবে তখনও একসঙ্গে খাবার খেতে পারিনি। আলাদা কক্ষে আমাদের খেতে হয়েছে।
তাই এবারের ভ্রমণ ছিল অনেক বেশি কঠিন আর চাপের। উহানজুড়ে ছড়িয়ে আছে মহামারি-পরবর্তী মনো-অভিঘাত।
শহরটিতে দীর্ঘদিন লকডাউন ছিল, আমার মনে হয় সেটি সব মিলিয়ে ৭৬ দিন। শহরের বাসিন্দারা বাসায় আটকে ছিলেন, মানুষ মারা গেছে এবং এ বিষয়ে অনেকে জানতেও পারেননি। এবং তখন থেকেই তাদের বিরুদ্ধে মহামারি ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে, এটিকে চীনা ভাইরাস, উহান ভাইরাস বলে অভিহিত করা হয়েছে। ফলে সেখানে ক্ষোভ ও দুঃখের একটি আবহ রয়েছে।
এ অবস্থা কি আপনাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে কঠিন করে তুলেছিল?
পিটার: না, আপনি কাজটি করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। আপনি জানেন, কাজের ধারা কেমন হতে চলেছে। আপনি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও বুঝতে পারছেন। আমি জানি না, আমরাই প্রথম বিদেশি ছিলাম কি না, যারা হুয়ানান সি ফুড মার্কেট ঘুরে দেখেছি, যে জায়গাটি এমনকি চীনা নাগরিকের জন্য এখনও নিষিদ্ধ। সেখানে কেবল চীনা রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদেরই প্রবেশাধিকার আছে। আমরা এমন চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করেছি, যারা প্রথম দিকের কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন।
এই মানুষেরা একটি ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন এবং এখন তারা চীনে নায়ক হিসেবে প্রশংসিত, যেখানে বাকি বিশ্ব এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে চীন এখনও ভাইরাসটির ফের সংক্রমণের বিষয়ে অবশ্যই শংকিত।
আপনি যখন বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন, তখন তারা পুরো পিপিই পরে উড়োজাহাজে ঢুকবে; আপনাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে আলাদা একটি পথ দিয়ে নামিয়ে আনা হবে; আপনাকে পরীক্ষা করা হবে। হোটেল পৌঁছানোর পর আপনাকে নিজের কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে দুই সপ্তাহ দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনার দরজার কাছে আসা প্রতিটি মানুষ সম্পূর্ণ পিপিই ঢাকা থাকবে। হোটেল কক্ষ থেকে আবর্জনা সরানো হবে হলুদ ব্যাগে করে, যাতে বায়ো-হ্যাজার্ডের চিহ্ন থাকবে।
চীন থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর আমার অভিজ্ঞতা ছিল একদম আলাদা, এমনকি কোয়ারেন্টিনে থাকার বিষয়ে আমি কোনো নোটিশও পাইনি। আমি নিউইয়র্ক রাজ্য অ্যাপে সাইন ইন করেছি, কিন্তু কেউ আমার বাড়ির দরজায় এসে কড়া নেড়ে বলেনি, ‘বাসার ভিতরে থাকুন।’
এবারের ভ্রমণ থেকে আপনি কি নতুন কিছু শিখেছেন?
পিটার: অনুসন্ধানের প্রথম দিন থেকে আমরা যেসব উপাত্ত পেয়েছি তা চীনের বাইরে থেকে কখনও জানা যেত না। হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটে বিক্রেতা কারা? তার কোথা থেকে পণ্যের জোগান পেতেন? প্রথম দিকে আক্রান্তরা কাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন? প্রথম সংক্রমণের তথ্য কতটা সঠিক? আক্রান্তদের অন্য গুচ্ছগুলোর বিষয়ে কী তথ্য রয়েছে?
এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যখন আরও তথ্য জানতে চেয়েছি, চীনা বিজ্ঞানীরা চলে গেলেন। এর কয়েক দিনের মধ্যে তারা সমস্ত বিশ্লেষণ হাজির করেন এবং আমরা নতুন তথ্য পেয়ে যাই। এগুলো পাওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেই সময়ে আপনি সত্যিই বেশি কিছু বলতে পারেন না। আমরা চেষ্টা করেছি, অনুসন্ধানের ওই পর্যায়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই দুর্বল করে না ফেলতে।
ওই মার্কেটের বর্তমান অবস্থা এখন কেমন? কী দেখেছেন সেখানে?
পিটার: উহানের মার্কেটটি (সি ফুড মার্কেট) ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা ১ জানুয়ারিতে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং চীনা রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ বিভাগ (সিডিসি) সেখানে বিজ্ঞানীদের একটি দল পাঠায়। এটি ছিল অনেক বিস্তৃত অনুসন্ধান, সেখানকার প্রতিটি জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
প্রথম দিকে অন্তত ৫০০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যার মধ্যে অনেক নমুনাতেই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসব নমুনার মধ্যে মৃত প্রাণী ও মাংসও রয়েছে। তবে সেখানে কী করা হচ্ছে সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য জনসমক্ষে আসেনি। আমরা উহানে যাওয়ার পর সেগুলো জানতে পেরেছি, এটি সত্যিই আমার জন্য চোখ খুলে দেয়ার মতো ঘটনা ছিল।
প্রকৃতপক্ষে তারা (চীনা বিজ্ঞানী) ৯০০টির বেশি নমুনা সংগ্রহ করে, যেটি ছিল এক বিশাল কাজ। তারা নর্দমা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে। ভ্যান্টিলেটর থেকে বাদুর ধরে পরীক্ষা করেছে। মার্কেটের আশপাশের প্রাণীর নমুনা নিয়েছে। তারা বিড়াল, বেওয়ারিশ বিড়াল, ইঁদুর, এমনকি একটি বেজির নমুনা নিয়েও কাজ করেছে। সাপ পরীক্ষা করেছে। মার্কেটে জীবন্ত সাপ, কচ্ছপ ও ব্যাঙ বিক্রি করা লোকজনকেও পরীক্ষা করা হয়েছে।
নমুনার মধ্যে জীবিত ও মৃত খরগোশ ছিল। খরগোশের একটি খামার সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ব্যাজার (গর্তবাসী এক জাতীয় ছোট নিশাচর প্রাণী) নিয়ে কথা উঠেছিল এবং চীনারা যে ব্যাজারের কথা বলে সেটি আসলে ফেরেট ব্যাজার। এর লেজ খানিকটা লম্বা। মার্কেটে যেসব প্রাণী আনা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাসের পোষক থাকতে পারে। এরা চীনের অন্য কোথাও বাদুড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে এবং তারপর তাদের হয়ত এই মার্কেটে আনা হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং এটা হলো করোনাভাইরাসের মানুষে সংক্রমণের উৎস সংক্রান্ত প্রথম ক্লু বা সূত্র।
সেখানে ১০টি দোকানে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো। বিক্রেতারা ছিলেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউনান, গুয়াংজি ও গুয়াংডং প্রদেশের বাসিন্দা। ইউনান প্রদেশে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের (কোভিড ১৯ এর জন্য দায়ী ভাইরাস) খুব কাছাকাছি নমুনা বাদুরের দেহে পাওয়া গেছে। গুয়াংজি ও গুয়াংডং প্রদেশ থেকে প্যাঙ্গোলিন ধরে এনে মার্কিটে বিক্রি হতো, এদের দেহেও প্রায় একই ধরনের ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
মার্কেটে আনা এমন অনেক সন্দেহজনক প্রাণী রয়েছে। কিছু প্রাণী এমন সব জায়গা থেকে আনা হয়েছে, যেখানে ভাইরাসটির কাছাকাছি ধরনের ভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানি। সুতরাং সেখানে প্রকৃত ঝুঁকি লুকিয়ে থাকতে পারে।
এখন চীনা দলটি সন্দেহজনক সব প্রাণীর দেহ ধ্বংস করেছে। তবে এগুলো হলো ফ্রিজে থাকা প্রাণীদের ছোট্ট একটি অংশ। আমরা জানি না সেখানে বিক্রি করার জন্য আর কী ছিল। সুতরাং এই দুটি সূত্র সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যখন মার্কেটটি দেখতে গেলাম, বিষয়টি আমাকে খুব তাড়িত করছিল। শাটার লাগানো সারিবদ্ধ ভবনের বন্ধ মার্কেটটির এখনকার ছবি দেখে আপনি হয়ত মনে করেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ শহুরে বাজার। এটিকে সত্যিই জীবন্ত প্রাণী বেচাকেনার জায়গা বলে মনে হয় না। তবে সরেজমিনে দেখলে একদম আলাদা মনে হবে। এটি খুবই ভগ্নদশার একটি মার্কেট।
দেখেই মনে হয়, জায়গাটি জীবিত প্রাণী বিক্রির জন্য তৈরি। জীবিত জলজ প্রাণী বিক্রির নিদর্শন যত্রতত্র ছড়ানো, রয়েছে কচ্ছপ, মাছের ট্যাঙ্ক, সাপের খোয়াড়, যেগুলো এখানে হরদম বিক্রি হতো বলে আমরা জানি। আমাদের কাছে এখন যে তথ্য আছে, তা হলো এটি ভাইরাসের একটি স্পষ্ট সম্পর্ক সূত্র ও ছড়ানোর একটি সম্ভাব্য পথ।
মহামারির প্রাদুর্ভাবের আগে সি-ফুড মার্কেটে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনাগুলো কেমন ছিল?
পিটার: হুয়ানান মার্কেটের বাইরেও অন্যদের মাঝে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছিল। এমন আরও কিছু রোগী আছেন যাদের সঙ্গে বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ ধরনের কিছু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সেখানে আরও কয়েকটি বাজার রয়েছে। আমরা এখন জানি কিছু রোগীর সঙ্গে অন্য বাজারের সম্পর্ক ছিল। আমাদের আরও কাজ করা দরকার এবং এরপর চীনা সহকর্মীদেরও বেশকিছু কাজ করতে হবে।
কাজের শেষ দিকে চীনা দল এবং ডাব্লিউইএচওর প্রতিনিধিরা যখন একসঙ্গে বসলাম, তখন বলা হলো, ‘আসুন আমরা একটি অনুমানের মধ্যে দিয়ে যাই’। সেখানে যে বিষয়টি সমর্থন পেয়েছে তা হলো, ঘরোয়া পরিবেশে আবদ্ধ বন্যপ্রাণী থেকে সংক্রমণ।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
পিটার: প্রাণীর সরবরাহ লাইনের ধারাটি খুবই স্পষ্ট। সরবরাহকারীদের পরিচয় জানা গেছে। তারা খামারের নাম জানে, এগুলোর মালিকদের সম্পর্কে জানে। খামারে গিয়ে তাদের মালিক ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তাদের পরীক্ষা করতে হবে। কমিউনিটির সদস্যদের পরীক্ষা করতে হবে। আপনাকে সরেজমিনে গিয়ে দেখতে হবে, খামারের কাছাকাছি সংক্রমিত কোনো প্রাণী আছে কিনা এবং তাদের আন্তঃসীমান্ত চলাচল রয়েছে কিনা। ভাইরাসটি যদি চীনের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী রাজ্যে থেকে থাকে, তাহলে আক্রান্ত প্রাণীদের সম্ভবত ভিয়েতনাম, লাওস বা মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশেও চলাচল রয়েছে। আমরা এখন এই ভাইরাসের কাছাকাছি ধরনের আরও ভাইরাস খুঁজে পাচ্ছি। এর একটি আছে জাপানে, একটি কম্বোডিয়ায় এবং একটি রয়েছে থাইল্যান্ডে।
মানুষের ক্ষেত্রে প্রথম দিকের গুচ্ছ ও আক্রান্তের দিকে লক্ষ্য রাখুন; সম্ভব হলে সিরামের জন্য ব্লাড ব্যাংকের দিকে নজর দিন। চীনের মধ্যে এ জাতীয় বিষয়গুলোকে এগিয়ে নেয়া বেশ স্পর্শকাতর এবং এটি করতে গেলে তাদের কিছুটা কূটনীতি এবং শক্তির আশ্রয় নিতে হবে। কারণ, সত্যি বলতে আমি মনে করি, নিজের দেশের ভেতরে এই ভাইরাসের উত্স অনুসন্ধান করার বিষয়টি চীনা সরকারের উচ্চ অগ্রাধিকারে নেই। যেখানেই এই ভাইরাসটির উৎস শনাক্ত হোক না কেন, সেটি শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক ইস্যু। এটি অন্যতম একটি সমস্যা।
এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রাণীকে কি আপনি সন্দেহ করছেন?
পিটার: বিষয়টি এখনও ধোয়াশাপূর্ণ। আমরা জানতে পারিনি সেখানে গন্ধগোকুল বেচাকেনা হয়েছিল কিনা। আমরা জানি, এরা খুব সহজে সংক্রমিত হয়। আমরা জানি না, চীনে বেজি জাতীয় প্রাণী বা কুকুরের মতো অন্য রোমশ প্রাণীর খামারগুলোর কী অবস্থা। এগুলোও পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
তবে আপনি যদি বলেন, ভাইরাসটির কোন পথে বিস্তারের সম্ভাবনায় আমি জোর দিচ্ছি; সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, ভাইরাসটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অথবা দক্ষিণ চীন থেকে বাদুড়ের মাধ্যমে একটি বন্যপ্রাণী খামারে সংক্রমিত হয়েছে। গন্ধগোকুল, ফেরেট ব্যাজার, কুকুর- এ ধরনের প্রাণী বাদুড় থেকে সংক্রমিত হতে সক্ষম।
হয় ওই খামারে কাজ করা লোকজন সংক্রামিত হওয়ার পর হুয়ানান মার্কেটে এসে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে, অথবা আক্রান্ত জীবন্ত বা মৃত প্রাণির মাধ্যমে সেটি বাজারে এসেছে। একবার এটি হুয়ানান বা উহানের অন্য কোনো মার্কেটে পৌঁছানোর পর জনঘনত্বের সুবিধা নিয়ে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ঘটায়।
বিক্রেতা এবং তাদের সরবরাহ চেইন সম্পর্কে যেসব নতুন তথ্য পেয়েছেন সেগুলো কি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে প্রকাশ করবেন?
পিটার: আশা করি করব। তবে সন্দেহাতীতভাবে কিছু বিষয় গোপন রাখা হবে। চীনের অভ্যন্তরীণ নীতি অনুযায়ী, রোগীদের পরিচয় গোপন রাখা হয়। পশ্চিমে একটি ধারণা হলো, চীনে একনায়কতান্ত্রিক শাসক সব নাগরিকের ভিডিও ধারণ করে। সব ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। তবে এরপরেও সেখানে রোগীদের তথ্য অত্যন্ত গোপনীয় এবং কিছু বিষয় কখনও প্রকাশ করা হয় না।
আমরা নির্দিষ্ট কিছু রোগীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তবে তারা দেখা করতে চাননি বলে কর্তৃপক্ষও তাদের বাধ্য করেনি। আশা করছি, বিক্রেতা ও সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যই থাকবে। যদি সেটি না থাকে, তারপরেও বলব, আমরা সেগুলো দেখেছি, সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমরা বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণে রাখব।
আরও পড়ুন:অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে ৩১ হাজার ভবন এবং ৪ হাজার যানবাহন ধ্বংসসহ ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ জানিয়েছে, ইরানে হামলার জেরে মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলকে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে।
ইহুদিবাদী দেশটির এই ক্ষয়ক্ষতিই প্রমাণ করে যে, সংঘাতের সময় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইসরায়েলের কি বিশাল এবং অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। যদিও ইসরায়েল গত ১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে আগে আগ্রাসন চালিয়েছিল এবং ১২ দিন ধরে ইরানের সামরিক, পারমাণবিক এবং আবাসিক এলাকায় আঘাত করেছিল।
ইসরায়েলকে সাহায়তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২গত ২ জুন ইরানের নাতানজ, ফোরদো এবং ইস্পাহানে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছিল। আগ্রাসনের পরপরই ইরানি সামরিক বাহিনী শক্তিশালী পাল্টা হামলা চালিয়েছিল। ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) অ্যারোস্পেস ফোর্স অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩-এর অংশ হিসেবে ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ২২টি প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে অধিকৃত অঞ্চল জুড়ে শহরগুলিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও, মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায়, ইরানি সশস্ত্র বাহিনী কাতারের আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যা পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি। ২৪ জুন কাতারের মধ্যস্থতায় কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গত রোববার একটি ধর্মীয় আদেশ বা ফতোয়া জারি করেছেন ইরানের শীর্ষ শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি। এই ফতোয়ায় তিনি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে ‘ঈশ্বরের শত্রু’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি বা শাসক ইসলামের নেতা বা শীর্ষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে হুমকি দেয়, সে ‘যুদ্ধপিপাসু’ বা ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তি’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
গ্র্যান্ড মুফতি আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি এই ফতোয়ায় বিশ্বের সব মুসলমানের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। কারণ তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বকে হুমকি দিয়েছে। ফতোয়ায় বলেন, যে ব্যক্তি বা শাসক ইসলামের নেতা বা শীর্ষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে হুমকি দেয়, সে ‘যুদ্ধপিপাসু’ বা ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তি’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইরানি আইন অনুযায়ী, যারা সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদের শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড, শূলবিদ্ধকরণ, অঙ্গচ্ছেদ অথবা নির্বাসন। ফতোয়ায় আরও বলা হয়েছে, এই শত্রুদের সঙ্গে মুসলিম বা কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কোনও ধরনের সহযোগিতা বা সমর্থন অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। সব মুসলমানের উচিত এই শত্রুদের কথাবার্তা ও কাজের জন্য তাদের অনুতপ্ত করা।
এছাড়াও এতে বলা হয়েছে, যদি কোনো মুসলমান তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পথে ক্ষতি বা কষ্টের সম্মুখীন হয়, তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার রাস্তায় সংগ্রামরত একজন যোদ্ধার পুরস্কার লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। এই ফতোয়ার পেছনে ইসরায়েল ও ইরানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনাকেই কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
ইরানি ধর্মীয় নেতারা এর আগেও ফতোয়া দিয়েছেন। ইরানের অন্যতম ভয়ংকর ফতোয়া জারি হয় ১৯৮৯ সালে। লেখক সালমান রুশদির ‘শয়তানের উক্তি’ বা দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাস প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করা হয়। অনেক মুসলমান মনে করেছিলেন যে বইটি তাদের ধর্মকে অবমাননা করেছে। সেই ফতোয়ার পর রুশদিকে আত্মগোপনে যেতে হয়।
‘৭ দিনের মধ্যে ইরানে ফের হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল’
ইরানে ফের যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তেহরানের একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ইরানের ওপর আবার হামলা হতে পারে। গতকাল সোমবার ইরান ইন্টারন্যাশনালের লাইভ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
রোববার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের প্রধান ইব্রাহিম মোত্তাকি বলেন, বর্তমান যুদ্ধবিরতি ইসরায়েল-আমেরিকার ‘সংঘবদ্ধ’ হওয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত সময়কাল মাত্র, এবং তারা শিগগিরই ইরানের তাদের আক্রমণ পুনরায় শুরু করবে। সাক্ষাৎকারে মোক্তাকি আরও বলেছেন, প্রাপ্ত প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েল সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে তাদের আকস্মিক ও ধ্বংসাত্মক সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু করবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধবিরতিকে তাদের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠন এবং সর্বোত্তম করার একটি উপায় হিসেবে দেখে বলে সতর্ক করেছেন ইরানি এই বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরিতে সহায়তা করেছিলযুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরিতে সহায়তা করেছিল। মোক্তাকি ইরানের কর্মকর্তাদের এই যুদ্ধবিরতি গুরুতরভাবে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইরানি কর্মকর্তারা এবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হবেন।
আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে যে শর্ত দিল ইরান
ইরান বলেছে, কূটনৈতিক আলোচনা আবার শুরু করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের ওপর নতুন করে হামলার চিন্তা বাতিল করতে হবে। দেশটির উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাখত-রাভানছি বিবিসিকে এ কথা বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে মাজিদ তাখত-রাভানছি বিবিসিকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে জানিয়েছে যে, তারা আলোচনায় ফিরতে চায়। কিন্তু আলোচনা চলাকালে নতুন করে হামলার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি।
ইরানে দখলদার ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিলো গত ১৩ জুন। ওমানের রাজধানী মাস্কটে তার দুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে ষষ্ঠ দফার আলোচনায় বসার কথা ছিল।
উত্তর মেক্সিকোর সিউদাদ জুয়ারেজের একটি বেসরকারি একটি শ্মশানে ৩৮১টি মৃতদেহ স্তূপীকৃত অবস্থায় সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। রোববার স্থানীয় প্রসিকিউটরের কার্যালয় এ তথ্য জানিয়েছে ।
মেক্সিকোর সিউদাদ জুয়ারেজ থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
চিহুয়াহুয়া রাজ্য প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের যোগাযোগ সমন্বয়কারী এলয় গার্সিয়া এএফপিকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ৩৮১টি মৃতদেহের সন্ধান পেয়েিেছ এবং সেগুলো আমাদের কাছে আছে। মৃতদেহগুলো অনিয়মিতভাবে শ্মশানে জমা করা হয়েছিল এবং সেগুলোকে দাহ করা হয়নি।’
গার্সিয়া বলেন, শ্মশানের ভবনে বিভিন্ন কক্ষে মৃতদেহগুলো ‘স্তূপীকৃত’ অবস্থায় ছিল।
তিনি বলেন, ‘মৃতদেহগুলোএকটির ওপরে আরেকটি মেঝেতে রাখা হয়েছিল। ‘সমস্ত মৃতদেহকে সুগন্ধিকরণ করা হয়েছিল। গার্সিয়া বলেন, ছাইয়ের পরিবর্তে আত্মীয়দের ‘অন্যান্য উপকরণ দেওয়া হয়েছিল।
কর্তৃপক্ষ অনুমান করেছে, কিছু দেহাবশেষ দুই বছর পর্যন্ত সেখানে থাকতে পারে। গার্সিয়া শ্মশান কতৃপক্ষের ‘অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতা কে দায়ী করেছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আপনি যতটা প্রক্রিয়া করতে পারেন তার চেয়ে বেশি নিতে পারবেন না।’শ্মশানের একজন প্রশাসক ইতোমধ্যেই নিজেকে প্রসিকিউটরদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
তবে, কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট করেনি মৃতদেহগুলো অপরাধমূলক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের কিনা। সংগঠিত অপরাধের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ মেক্সিকো বছরের পর বছর ধরে ফরেনসিক ব্যবস্থার সংকটে ভুগছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মৃতদেহের সংখ্যাধিক্য, কর্মীদের অভাব এবং অর্থের সীমাবদ্ধতা।
ফিলিস্তিনের গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় গত শুক্রবার জানিয়েছে, মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণ কেন্দ্রগুলো থেকে বিতরণ করা আটার ব্যাগে অক্সিকোডোন নামের মাদক বড়ি পাওয়া গেছে। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে তারা। এক বিবৃতিতে ওই কার্যালয় বলেছে, ‘আমরা এখন পর্যন্ত চারজনের সাক্ষ্য পেয়েছি। তারা আটার ব্যাগের ভেতরে এই বড়িগুলো পেয়েছেন।’ কার্যালয় সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ‘কিছু মাদক ইচ্ছাকৃতভাবে গুঁড়া বা দ্রবীভূত করে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
অক্সিকোডোন একটি শক্তিশালী মাদক, যা মূলত ক্যানসার রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি ও তীব্র ব্যথা উপশমে ব্যবহার করা হয়। এ মাদক অত্যন্ত আসক্তিকর এবং এর জীবননাশক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এর মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, বিভ্রম ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে গাজায় বিতরণ করা আটার ব্যাগে বড়ি পাওয়া যাওয়ার ছবি প্রকাশ হয়েছে। পরে গাজা কর্তৃপক্ষ ওই বিবৃতি দেয়।
গাজার একজন ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ এ ঘটনাকে ‘গণহত্যার সবচেয়ে জঘন্য রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফেসবুকে গাজার চিকিৎসক খলিল মাজেন আবু নাদা লিখেছেন, ‘এই মাদক ‘আমাদের সামাজিক চেতনা ধ্বংস করার একটি অস্ত্র’।’ এভাবে ‘মাদকাসক্তি ছড়ানো ও ফিলিস্তিনি সমাজের বন্ধন ভেঙে দেওয়ার জঘন্য অপরাধের’ জন্য পুরোপুরি ইসরায়েলকেই দায়ী করছে গাজার গণমাধ্যম কার্যালয়।
কার্যালয় আরও বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার অবরুদ্ধ অবস্থাকে ‘সাহায্য ও সহায়তার’ ছদ্মাবরণে মাদক পাচারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুকূপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তারা।
জিএইচএফের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) একটি বিতর্কিত মার্কিন-ইসরায়েলি সংস্থা। বর্তমানে গাজায় ত্রাণ বিতরণে যুক্ত রয়েছে সংস্থাটি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকার অভিযোগে জিএইচএফের তীব্র সমালোচনা করেছে।
গত বুধবার ১৫টি মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা সংস্থা জিএইচএফের কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানিয়েছে। তারা বলেছে, এ সংস্থা আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত করছে এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের ‘জবরদস্তিমূলক বাস্তুচ্যুতি’ ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কিংবা গণহত্যার মতো অপরাধে সহায়তা করে থাকতে পারে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, জিএইচএফের কার্যক্রম চলাকালে গত এক মাসে সহায়তা কেন্দ্রগুলোর আশপাশে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ৫১৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
শুক্রবার ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ জানায়, ইসরায়েলি সেনারা স্বীকার করেছেন যে তারা জিএইচএফ পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছেন। মিডল ইস্ট আই জিএইচএফের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চেয়েছে।
গাজায় অপুষ্টিতে ৬৬ শিশুর মৃত্যু
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার প্রশাসনের অভিযোগ দুধ, পুষ্টিকর খাদ্য এবং অন্যান্য মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেয়াতেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এক বিবৃতিতে গাজার মিডিয়া প্রশাসন জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই অবরোধ একটি যুদ্ধাপরাধ। বেসামরিক লোকদের নির্মূল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্যই এমন ঘটনা ঘটছে।
এদিকে গাজার তুফাহ, দেইর আল বালাহ, রাফা, খান ইউনিসসহ বেশ কয়েকটি এলাকাতেই চলছে ইসরায়েলি বিমান হামলা। গত শনিবার একদিনে নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন, তাদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী।
আল জাজিরা বলছে, গত শনিবার ভোরে গাজা সিটির আল তুফাহ এলাকায় ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলায় কেঁপে ওঠে চারপাশ। বিস্ফোরণের সময় গাজাবাসী আশ্রয় নিচ্ছিল জাফা স্কুলের পাশে একটি বহুতল ভবনে। ভবনটির তিনটি তলা একসঙ্গে ধসে পড়ে। এ ঘটনায় শিশুসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। পরিবারের আহাজারি আর ক্লান্তিমাখা চেহারায় শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকাজুড়ে।
ফিলিস্তিনের স্টেডিয়ামের পাশে আরও একটি আশ্রয় কেন্দ্রে ইসরায়েলি বোমা হামলায় বেশ কয়েকজন হতাহত হন। হামলায় আহতদের অনেকেই শিফা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান।
তবে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেও চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কেননা হাসপাতালের অর্ধেক কর্মী এরমধ্যেই নিহত বা গুম হয়েছেন। এছাড়া দেইর আল বালাহতে দুপুরের দিকে একটি রাস্তায় বোমার আঘাতে একসঙ্গে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যার প্রায় চার শতাংশ। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি, গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরোক্ষ প্রভাব যেমন: ক্ষুধা, ঠান্ডা এবং রোগ-ব্যাধির কারণেও অনেক মানুষ মারা গেছে।
‘হামাসের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়ায় আছেন নেতানিয়াহু’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। একটি দীর্ঘ পোস্টে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধের নায়ক হিসেবে উল্লেখ করে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ট্রাম্প। দুর্নীতির মামলায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান মামলার নিন্দাও জানিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। শনিবার রাতের ওই পোস্টে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলেন, ইরানের বিপজ্জনক পারমাণবিক হুমকি থেকে মুক্তি পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্দান্ত কাজ করেছেন নেতানিয়াহু। ট্রাম্প বলেন, তিনি (নেতানিয়াহু) এখন হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, যার মধ্যে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এদিকে ইরানে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর নিজের দেশে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিষয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। গত মার্চে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এমন একটি যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন যেটি সুফল বয়ে আনছিল। তার এই সিদ্ধান্তকে ওই সময় ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। এটি ছিল গাজা যুদ্ধবিরতি।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী রোববার উত্তর গাজা উপত্যকার এলাকা থেকে অধিবাসীদের সরে যেতে সতর্কতা জারি করেছে। এরমধ্যে গাজা শহরের কিছু অংশ এবং আশেপাশের এলাকার কিছু অংশও রয়েছে। হামাসের সাথে যুদ্ধের ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে।
জেরুজালেম থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আভিচায় আদরাই উত্তর গাজার মানচিত্রের সাথে এক্স-এ এক পোস্ট করে এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য ‘অবিলম্বে দক্ষিণে আল-মাওয়াসির দিকে নাগরিকদের সরে যেতে’। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সক্ষমতা ধ্বংস এবং তাদের প্রতিহত করার জন্য ইসরাইলি বাহিনী এই এলাকাগুলোতে তীব্র শক্তি প্রয়োগ করবে এবং সামরিক অভিযানগুলো তীব্র এবং প্রসারিত হবে’।
শনিবার মার্কিন সিনেটররা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল’ ব্যয় বিল নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছেন। বিলটি একটি বিশাল বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রস্তাব যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভ্যন্তরীণ এজেন্ডার মূল অংশগুলো অর্জন করবে এবং একই সাথে সমাজকল্যাণ কর্মসূচিতে ব্যাপক কাটছাঁট করবে।
ওয়াশিংট থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
ট্রাম্প ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ দিয়ে তার উত্তরাধিকার সিলমোহর করার আশা করছেন, যা তার মেয়াদ শেষ হওয়া প্রথম-মেয়াদী কর কর্তনকে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রসারিত করবে এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করবে।
তবে, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনের দিকে নজর রাখা রিপাবলিকানরা এই প্যাকেজ নিয়ে বিভক্ত, যা লাখ লাখ দরিদ্র আমেরিকানদের স্বাস্থ্যসেবা কেড়ে নেবে এবং দেশের ঋণে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি যোগ করবে।
শনিবার গভীর রাতে রিপাবলিকান সমর্থকরা প্রক্রিয়াগত ভোট বিলম্বিত করার পর সিনেট আনুষ্ঠানিকভাবে বিলটির ওপর বিতর্ক শুরু করে। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্পের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভোটাভুটির প্রথম আহ্বানের কয়েক ঘন্টা পরেই সিনেটররা ৫১-৪৯ ভোটে বিতর্ক শুরু করার প্রস্তাবটি পাস করেন, যেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তার নিজের দলের হোল্ডআউটদের সাথে আলোচনায় যোগ দেন।
অবশেষে, দুই রিপাবলিকান সিনেটর উদ্বোধনী বিতর্কে ‘না’ ভোট দিয়ে ৪৭ জন ডেমোক্র্যাটের সাথে যোগ দেন।
ট্রাম্প তার দলকে ৪ জুলাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে বিলটি পাস করার জন্য এবং স্বাক্ষর করার জন্য তার ডেস্কে রাখার জন্য চাপ দিয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটরা আইনটির এবং ট্রাম্পের এজেন্ডার তীব্র বিরোধিতা করছেন এবং বিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা বিতর্ক শুরু হওয়ার আগে বিলটির সম্পূর্ণ অংশ চেম্বারে জোর দিয়ে শোনানোর মাধ্যমে শুরু করেছিলেন।
বিলটি প্রায় ১ হাজার পৃষ্ঠা দীর্ঘ এবং এটি পড়তে আনুমানিক ১৫ ঘন্টা সময় লাগবে।
সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার বলেন, ‘বিলে কী আছে, রিপাবলিকানরা আমেরিকাকে তা জানাবে না, ‘তাই ডেমোক্র্যাটরা এটিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করছে। এটি পড়ার জন্য প্রয়োজনে আমরা সারা রাত এখানে থাকব।’
এই সপ্তাহের শুরুতে তেহরানের এভিন কারাগারে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৭১ জন নিহত হয়েছে বলে রোববার ইরানের বিচার বিভাগ জানিয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, দুই চিরশত্রুর মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধ বিরতি শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর এ হামলা চালানো হয় বলে দাবি করেছে তেহরান।
বিচার বিভাগের মুখপাত্র আসগর জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ওই হামলায় এভিন কারাগারে ৭১ জন নিহত হয়েছে।’
১৩ জুন ইসরাইলের বোমা হামলা শুরু করলে সোমবার তেহরানের উত্তরে অবস্থিত ভারী সুরক্ষিত কমপ্লেক্সে ৭১ জন নিহত হয়।
ইসরাইলি বাহিনী শনিবার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বিধ্বস্ত অঞ্চলে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে নয়জন শিশুসহ ৩৭ জনকে হত্যা করেছে। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা এ তথ্য জানায়। গাজা সিটি থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
বেসামরিক প্রতিরক্ষা মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে জানান, বিভিন্ন স্থানে সাতটি ইসরাইলি ড্রোন ও বিমান হামলায় ৩৫ জন এবং গাজার মধ্যাঞ্চলীয় নেটজারিম জোনে খাদ্য সহায়তার জন্য অপেক্ষা করার সময় ইসরাইলের গুলিতে আরও দুজন নিহত হয়েছে।
তিনি বলেন, নিহতদের মধ্যে গাজার উত্তরাঞ্চলীয় জাবালিয়ায় একটি বাড়িতে বিমান হামলায় তিনজন শিশু নিহত হয়।
বাসাল বলেন, গাজা নগরীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি পাড়ায় কমপক্ষে ছয় শিশু নিহত হয়েছে, একটি স্কুলের কাছে আশ্রয় নেওয়া কিছু বাস্তুচ্যুত মানুষও বিমান হামলায় নিহত হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাবাহিনী মন্তব্যের অনুরোধের জবাব দেয়নি।
গাজায় বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারোট শনিবার বলেছেন ‘তার দেশ ও ইউরোপ গাজায় খাদ্য বিতরণের নিরাপত্তায় অবদান রাখতে প্রস্তুত।’
তিনি আরও বলেন, এই ধরনের উদ্যোগ হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাহায্য পাওয়ার ইসরাইলি উদ্বেগেরও সমাধান করবে।
গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সাহায্য বিতরণে ফ্রান্স কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে সম্পর্কে ব্যারোট কোনও বিবরণ দেননি।
গাজায় গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ এবং অনেক এলাকায় প্রবেশের অসুবিধার কারণে এএফপি স্বাধীনভাবে মৃতের সংখ্যা এবং উদ্ধারকারীদের দেওয়া বিবরণ যাচাই করতে পারছে না।
এএফপির ছবিতে দেখা গেছে গাজা নগরীর আল-শিফা হাসপাতালে সাদা কাফন ও কম্বলে মোড়ানো কমপক্ষে দুই শিশু সহ সাতজনের মৃতদেহ ঘিরে শোকাহতরা কাঁদছেন।
গাজা নগরী থেকে ধারণ করা অন্যান্য এএফপির ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার পর ভবনগুলো থেকে ধোঁয়ার মেঘ উঠছে।
জাবালিয়ায়, একজন এএফপির আলোকচিত্রী বেসামরিক প্রতিরক্ষা উদ্ধারকারীদের পিঠে রক্তাক্ত অবস্থায় একজন ব্যক্তিকে সাহায্য করতে দেখেছেন।
মন্তব্য